আহাদ চৌধুরী তুহিন,অমৃতালোক :
আজ শনিবার( ১১ জানুয়ালি’২০২৫) দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ভোটের দাবিতে শিগগির মাঠে নামছে বিএনপি’-এটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ চান জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কিছুটা এগিয়ে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে, এমন একটি ধারণা সম্প্রতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে কোনটি কখন হতে হবে, কীভাবে হবে, সে বিষয়ে সরকার, বিএনপিসহ বড় দলগুলো এবং অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে বলছে, এ সংস্কার মূলত হতে হবে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ আগে নেওয়া হলেও তা সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে বৈধতা পাবে। এ কারণে দলটি সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। এমন দাবিতে প্রয়োজনে মাঠে নামার পরিকল্পনাও করছে দলটি।
বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানালেও সরকারের তরফ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে সম্প্রতি। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমমনা কয়েকটি সংগঠন সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আগে করার দাবি তুলছে। ইউনিয়ন পরিষদ ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ফেসবুক পোস্ট একসঙ্গে নিয়ে পুরো বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
মাঠপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান গত বৃহস্পতিবার সরকারের অন্য তিন প্রভাবশালী উপদেষ্টাকে যুক্ত করে একটি ফেসবুক পোস্ট দেন।
দুটি প্রশ্ন জুড়ে দিয়ে করা ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনের কথা বলেছেন। দলীয় প্রতীকবিহীন প্রার্থীদের নিয়ে এসব নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের আপত্তির সুযোগ কোথায়? স্বাধীন ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ছাড়া, একদলীয় শাসন থেকে মুক্তির অন্য কোনো উপায় আছে কী?’
অন্য যে তিন উপদেষ্টাকে ফেসবুক পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে, তাঁরা হলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মো. নাহিদ ইসলাম ও আইন মন্ত্রণালয়ের আসিফ নজরুল।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা গত বুধবার ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বেয়ারকে জানান, সরকার জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি একই সঙ্গে নিচ্ছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার বিষয়টি সরকার নিশ্চিত করতে চায়।
বিএনপির নেতৃত্ব মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে তৈরি করা প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটির মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সুবিধা ব্যবহার করে সারা দেশে নতুন রাজনৈতিক দল দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সময় নিতে সামনে আনা হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গগুলো।
বিএনপির নেতাদের অনেকের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় দলের চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিদেশে যাওয়ার পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে করা একটি পোস্ট থেকে। ৮ জানুয়ারি করা এ পোস্টে বলা হয়, ‘দুই আপামুক্ত’ এই প্রথম বাংলাদেশ। ফেসবুক পোস্টটি পরে সরিয়ে নেওয়া হলেও সেদিনই তা বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের নজরে আসে।
খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার প্রসঙ্গটিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জুড়ে দিয়ে মন্তব্যটি করা হয়েছে, এমনটি মনে করছে বিএনপি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘পদত্যাগ করে’ ৫ আগস্ট দিল্লি চলে যান। আর খালেদা জিয়া ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এ পোস্টটি সরকারের কয়েকটি প্রভাবশালী মহল ও সম্প্রতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনের অনেক নেতার দুরভিসন্ধি স্পষ্ট করে দিয়েছে। এই মহলগুলো খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে রেখে ও সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করে তাঁরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য’। খবরে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এ বক্তব্যের পর জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে কি না, এ আলোচনা সামনে এসেছে। কারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় নির্বাচন করতে চাইলে তা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই করতে হবে। সংসদ নির্বাচন করার পর তারা আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুযোগ পাবে না। তাদের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতপার্থক্য আছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিপক্ষে। আর জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। কোনো কোনো দল অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছে।
এদিকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোরও প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন—সব স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে একটি আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে ভাবছে সংস্কার কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে কমিশন। কমিশনের মূল্যায়ন হলো, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। এর পক্ষে প্রধানত দুটি যুক্তি এসেছে। প্রথমত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের অনেক জনপ্রতিনিধিও আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে বেশির ভাগ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন নির্বাচন কমিশনের একটি পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা হবে। সরকারও সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়েরমানুষের মতামতের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়।
গত বুধবার ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। যদিও চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনগণ নিয়মিত সেবা পাচ্ছে না। প্রশাসক দিয়ে এটি সামলানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মূলত এটি একটি প্রস্তাব আকারে স্যার (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি হয়, তাহলে নাগরিকদের এই সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে পারব।’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন মনে করে, দুটি কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা ও প্রয়োজনীয় আইনবিধি সংস্কার করে সরকার চাইলে চলতি বছরের জুন বা তার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিকে যেতে পারবে।
‘অপ্রয়োজনে আট স্থলবন্দর, গচ্চা সাড়ে চারশ কোটি টাকা’-এটি দৈনিক যুগান্তরের প্রধান শিরোনাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি স্থলবন্দর। ওই তিনটি বন্দরের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৬০.৪ একর জমি। সেখানে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে অন্তত ১৪৩ কোটি টাকা। অথচ এই তিনটি স্থলবন্দর চলছে ঢিমেতালে। পণ্য না থাকায় কখনো কখানো বন্দর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। যদিও এসব বন্দরে রাজস্ব বিভাগ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত অবস্থান করতে হয়। এ পর্যন্ত এই তিন স্থলবন্দর থেকে ২০ কোটি টাকাও আয় হয়নি কর্তৃপক্ষের। ওই তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণের নেপথ্যে ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তিনজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এবং এক মুখ্য সচিব।
বন্দর তিনটি হচ্ছে-শেরপুরের নাকগাঁও, ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী এবং জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই তিন জেলায় একটি অথবা সর্বোচ্চ দুটি স্থলবন্দরই যথেষ্ট। সেখানে তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় মাত্র তিন কিলোমিটার ব্যবধানে গোবড়াকুড়া ও কড়ইতলী নামে দুটি পৃথক শুল্ক স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও এ দুটি টার্মিনালের বিপরীতে ভারতের মেঘালয়ে একটি মাত্র স্থলবন্দর রয়েছে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে সারা দেশে আটটি স্থলবন্দরের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো দেশের মানুষের উপকারে তেমন কাজে আসছে না। এসব বন্দরকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে জানিয়েছেন স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রভাবশালীদের তদবির বা চাপে সেগুলোকে বন্দর ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ওই আটটি স্থলবন্দরের মধ্যে ছয়টির কার্যকারিতা নেই। কয়েকটির ভারতীয় অংশে কোনো স্থাপনাও নেই। অথচ এসব স্থলবন্দর নির্মাণে এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে চারশ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। প্রায় ৮৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণ করেছে বিশাল বিশাল অবকাঠামো। স্থলবন্দর হিসাবে ব্যবহার না থাকায় এসব অবকাঠামো এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওই আট স্থলবন্দর হচ্ছে-খাগড়াছড়ির রামগড়, রাঙামাটির তেগামুখ, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ, নীলফামারীর চিলাহাটী, হবিগঞ্জের বাল্লা, দিনাজপুরের বিরল, জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুর এবং ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী। দিনাজপুরের বিরল ছাড়া বাকি সাতটি স্থলবন্দর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি। বিরল স্থলবন্দর বিএনপির আমলে ঘোষণা করা হয়। ওই বন্দর উন্নয়ন করেছে বেসরকারি অপারেটর।
অপ্রয়োজনীয় স্থলবন্দরের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর জানতে পারলাম অনেক স্থলবন্দর জনগণের উপকারে আসছে না। অথচ সেখানে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ওইসব বন্দর এখন দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, যেসব বন্দর মানুষের কাজে লাগছে না, সেগুলোর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে দিয়েছি। ওই কমিটিতে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি আছেন। ওই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম ‘আস্থাহীনতায় সংকটে বিনিয়োগ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতিতে সুখবর নেই। ক্ষমতার পালাবদলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে; ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা। ডলার সংকট, দফায় দফায় করকাঠামোর পরিবর্তন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট, উচ্চ সুদের হারসহ আরো নানা সমস্যা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংকট সামাল দিতে চেষ্টা করছে, কিন্তু এতে এখনো তেমন সুফল দেখা যাচ্ছে না।
উল্টো ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রসারের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধারাবাহিক কমতে থাকা বিনিয়োগ তলানিতে নামতে সময় লাগবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে দেশে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে ব্যবসার পরিধি। মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টায় দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোয় ব্যাংকঋণের সুদ অনেক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্বল অর্থনীতির সূচকে আটকে গেছে ব্যবসার গতি। সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং আকাশচুম্বী সুদের চাপে পড়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা ব্যবসার জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কম থাকায় আমদানি সীমিত।
অস্থিতিশীল ডলারের দাম স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য অন্তরায়। দেশি বিনিয়োগ না হলে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে বিভিন্ন খাতে দেওয়া করছাড় সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগ হারাবে। পরিকল্পনা নেওয়া বিনিয়োগ থেকে অনেকে সরে আসবেন।
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার শিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক দল তৈরি করে বাংলাদেশকে প্রচারের তাগিদ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
দৈনিক সমকালের প্রধান শিরোনাম ‘কষ্টে চলা মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়ল’। প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা কারণে গেল বছর নিত্যপণ্যের বাজার ছিল রীতিমতো ‘পাগলা ঘোড়া’। দামের চোটে বছরজুড়ে গড় মূল্যস্ফীতি থেকেছে দুই অঙ্কের ঘরে। খরচা ছুটলেও মানুষের রোজগার বাড়েনি তেমন। উল্টো চাকরি খুইয়ে ধুঁকছেন অনেকে। এর মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে হাজির শতাধিক পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক-কর। এতে নাটাই যেভাবে ছুটবে, তাতে জীবনযাত্রা খরচার সামাল দেওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে নির্ধারিত আয়ের মানুষের। গেল আগস্টে দেশের রাজনৈতিকে মঞ্চ বদলের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, তাও ফিকে হয়ে আসছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক-করের পরিমাণ না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো উচিত। বিভিন্ন খাতে অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা ভ্যাট দিচ্ছেন না। কর হার কমিয়ে এসব ব্যবসায়ীকে ভ্যাটের আওতায় আনা গেলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। তবে সরকার সে পথে না হেঁটে যারা নিয়মিত ভ্যাট দিচ্ছেন, তাদের ওপরেই আরও বোঝা চাপাল। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। বাড়বে কর ফাঁকির প্রবণতাও। তারা মনে করেন, সরকারের উচিত, প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি বা কমানো, ভ্যাট ব্যবস্থা সহজ করা। পাশাপাশি ভ্যাট কমিয়ে করের আওতা বাড়ানো।
তবে ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট-ট্যাক্সের বড় অংশই ব্যবসায়ী ও এনবিআরের কর্মকর্তারা মিলেমিশে লুটছেন। তা জমা হয় না সরকারের কোষাগারে। অথচ কর ফাঁকির এই মহোৎসবের কারণে বারবার বলি হচ্ছে মানুষ। রাজস্ব আয় বাড়ানোর ব্যাপারে এনবিআরের গরজ থাকলেও কর ফাঁকি ও চুরি বন্ধে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো মাথাব্যথা নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নতুন করে বাড়তি শুল্ক-করে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। তারা অন্য কোনো কৌশলে রাজস্ব বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের দাবি, জবাবদিহি না থাকায় অনির্বাচিত সরকারের এ সিদ্ধান্ত মানবে না জনগণ।
‘ক্রেতাদের ওপর আরো চাপ’-এটি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম। খবরে বলা হয়, ফুটপাতে বা দোকানে আপেল, মাল্টা বা আঙুরের মতো ভিটামিনের চাহিদা মেটানোর ফলগুলো সাজানো থাকলেও কেনার আগে সক্ষমতার হিসাব কষতে হয় মধ্যবিত্তকে। আর নিম্নবিত্তের যেন ধরতেও মানা। আমদানি শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় ঊর্ধ্বমুখী বাজারে এসব ফলের দাম আরো বাড়বে। এনবিআর ও সরকারের ভাষায় এসব নিত্যপণ্য নয় বলে ভোক্তাপর্যায়ে পড়বে না তার প্রভাব। কিন্তু অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বলছেন ভিন্ন কথা।
শুধু আপেল, মাল্টা, আঙুর নয়—এনবিআরের প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ওষুধ, কোমল পানীয়, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এসব পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক (এসডি) বাড়িয়ে দুটি নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ মনে করছেন অপ্রত্যাশিতভাবে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে এসব পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে; যেমন মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচ বাড়বে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খরচ বাড়বে। পোশাক কেনার ক্ষেত্রে যোগ হবে বাড়তি খরচ।
ফলে বাজেটের আগেই এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতিমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে শুরু করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সবচেয়ে ভালো হতো।
ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, যে ধরনের পণ্যে ভ্যাট বসানো হয়েছে, সেগুলো একেবারেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য না হলেও এগুলো প্রায় সব সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেন; যেমন—কাপড়ছোপড়, সাবান, ডিটারজেন্ট, আচার, রেস্তোরাঁয় যাওয়া, মোবাইলফোন ব্যবহার, সিমকার্ড এগুলো সাধারণ মানুষ সবাই ব্যবহার করে। তিনি বলেন ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এসব পণ্যমূল্য বাড়বেই। এটির একটি চাপ সব মানুষের ওপর আসবে।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না। কারণ, অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির মূল ইন্ডিকেটরগুলো হলো চাল, ডাল এগুলো। আর আমরা যেসব জিনিসের ওপর কর বাড়াচ্ছি, এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না কষ্ট হবে।”
অবশ্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই মুহূর্তে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজস্ব আয় বাড়ার পরিবর্তে উলটো কমতে পারে। তারা বলছেন, এমনিতেই মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সেখানে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টম্যাটো কেচাপ বা সস, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান-ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পলের ওপর ভ্যাট হার বৃদ্ধি মানুষকে আরো চাপে ফেলবে।